পরমাণুর মুল কণিকাগুলির আবিষ্কার ও তার গঠন বিষয়ক মডেলের কালানুক্রমিক সংক্ষিপ্তসার: Discovery of sub-atomic particle (Discovery of Electron, ...
পরমাণুর মুল কণিকাগুলির আবিষ্কার ও তার গঠন বিষয়ক মডেলের কালানুক্রমিক সংক্ষিপ্তসার:
Discovery of sub-atomic particle (Discovery of Electron, Discovery of Proton, Discovery of Neutron) & evolution and history of Atomic Model (Plum-pudding Model, Rutherford Atomic Model, Bohr Atomic Model ) in the century:
[500 খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ] পরমাণু সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা:
Discovery of sub-atomic particle (Discovery of Electron, Discovery of Proton, Discovery of Neutron) & evolution and history of Atomic Model (Plum-pudding Model, Rutherford Atomic Model, Bohr Atomic Model ) in the century:
[500 খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ] পরমাণু সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা:
প্রায় খ্রীষ্টজন্মের কয়েক শতাব্দী পূর্বে (প্রায় 500 B.C.) যেকোনো মৌলের শেষ উৎস জানতে পরমাণুর ধারণা প্রথম কল্পনা করা হয়। এই ব্যাপারে ভারতীয় দার্শনিক ঋষি কণাদকে সর্বপ্রথম পরমাণুর ধারণার পথিকৃৎ বলে মনে করা হয়। তাঁর মতে পরমাণু হল "সদ্কারন্বন্নিত্যম্"। এর অর্থ হল পরমাণু সদ্ অর্থাৎ অস্থিত্ব আছে এমন কিছু, নিত্যম অর্থাৎ যা চিরন্তন, অক্ষয় এবং অখন্ডনীয়। এর উৎস বা কারণ নেই। এই বিশাল বিশ্বসংস্থিতির মধ্যে কণামাত্র স্থানে এর অবস্থান। অতি সুক্ষ যা চোখে দেখা যায় না অথচ এটিই সমস্ত সৃষ্টির মুলে।
পরমাণুর অস্থিত্ব সম্পর্কে প্রাচীন ধারণা:
ঋষি কণাদের এই ধারণাতে অবাক হয়েছিলেন গ্রীক দার্শনিক লুসিপ্পাস (Leucippus) এবং তাঁর শিষ্য ডেমোক্রিটাস (Democritus)। পরে তাঁরাও ধারণা করেন যেকোনো পদার্থ অখন্ডনীয় এবং অতি সূক্ষ কণা দ্বারা গঠিত। তাঁরা এই কণাগুলির নামকরণ করেছিলেন Atom। গ্রীক শব্দ Atomos থেকেই এই Atom শব্দটির উৎপত্তি। এই Atomos শব্দের অর্থ "not divisible"। এরপর বেশ কয়েক শতাব্দী কেটে যায় কিন্তু পরমাণু সম্পর্কে কেউ কোনো ধারণা আর দিতে পারে নি। আর পরমাণুর চেয়ে ক্ষুদ্রতর কোনো কণার অস্থিত্বও জানা যায় নি।
[1808 খ্রীষ্টাব্দ]
ডালটনের পরমাণুবাদ:
ডালটনের পরমাণুবাদ:
এরপর ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডালটন বেশ কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন রাসায়নিক সংযোগ সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন যে পদার্থের একটি সর্বশেষ অংশ আছে এবং তারা একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে যুক্ত হয় ও বিযুক্ত হয়। অবশেষে 1808 খ্রীষ্টাব্দে পরমাণুর বৈশিষ্ট্যগত ও বাস্তবসম্মত একটি তত্ত্বের উপস্থাপণা করেন, যা ডালটনের পরমাণুবাদ নামে খ্যাত। ডালটনের পরমাণুবাদই সর্বপ্রথম পরমাণুর ধারণাকে দার্শনিক তত্ত্ব থেকে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় নিয়ে আসে। তাঁর পরমাণুবাদটি ছিল:
(1) প্রত্যেক পদার্থ অসংখ্য অবিভাজ্য কণা দ্বারা গঠিত। এই কণাগুলির নাম হল পরমাণু বা অ্যাটম।
(2) একই মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলির আকার, আকৃতি, ভর ও রাসায়নিক ধর্মে একই হয়।
(3) বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলির আকার, আকৃতি, ভর ও রাসায়নিক ধর্মে আলাদা হয়।
(4) রাসায়নিক বিক্রিয়া বা কোনো উপায়ে পরমাণুকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না।
(5) রাসায়নিক পরিবর্তনের সময় পরমাণুগুলি অখন্ড কণারূপে সরল অনুপাতে যুক্ত হয়ে যৌগিক অণু গঠন করে।
[1834 খ্রীষ্টাব্দ] মাইকেল ফ্যারাডের পরমাণু সম্পর্কিত একটি ধারণা:
এরপর 1834 খ্রীষ্টাব্দে মাইকেল ফ্যারাডে কিছু পদার্থের দ্রবণে তড়িৎচালনা করার সময় দেখলেন পদার্থগুলির রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটছে। এর থেকে তিনি উপলব্ধি করলেন যে পদার্থের আধানগত কোনো বৈশিষ্ট্য আছে এবং পরমাণুর সঙ্গে এই আধান বা চার্জের নিশ্চই কোনো যোগসূত্র আছে। এই ধারণা যে সত্যি তা বুঝতে বিজ্ঞানীদের আরও কয়েক বছর কেটে গেল। ঊনিশ শতকের শেষদিকে ক্যাথোড রশ্মির আবিষ্কারে পরবর্তীকালে প্রমাণ মিলল যে পরমাণুর ভিতরে আরও কণিকা আছে এবং তা আধানগ্রস্থ।
[1878 খ্রীষ্টাব্দ]
ক্যাথোড রশ্মির আবিষ্কার:
বিজ্ঞানী প্লুকার (1858) ও গোল্ডস্টাইন (1876) তড়িৎমোক্ষণ নল (Discharge Tube) নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। অবশেষে 1878 খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম ক্রুক্স তড়িৎমোক্ষন নলের অভ্যন্তরের বায়ুর চাপ 0.01 mm - 0.001 mm রেখে উচ্চবিভব প্রভেদ প্রায় 10,000 volt বিভবপ্রভেদ প্রয়োগ করে তড়িৎমোক্ষণ নলে ক্যাথোড রশ্মি তৈরি করেন। তিনি দেখেন ক্যাথোড পাত থেকে একপ্রকার অদৃশ্য রশ্মি লম্বভাবে নির্গত হয়ে দ্রুতগতিতে অ্যানোড পাতের দিকে যাচ্ছে এবং অ্যানোডের চারপাশের দেওয়ালে রঙিন প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করছে। ক্যাথোড থেকে এই রশ্মি নির্গত হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে এই রশ্মির নাম দেওয়া হয়েছিল "ক্যাথোড রশ্মি (Cathode Ray)"।
[1878 খ্রীষ্টাব্দ] ক্যাথোড রশ্মির ধারণা থেকে ইলেকট্রনের অস্থিত্বের প্রমাণ:
1897 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী জে. জে. থমসন এবং বিজ্ঞানী স্টোনি এই ক্যাথোড রশ্মির উপর বিস্তৃত গবেষণা করেন। তাঁদের গবেষণায় ক্যাথোড রশ্মি থেকে যে যে বৈশিষ্ট্য বা তথ্যগুলি পাওয়া গিয়েছিল তা হল:
(1) ক্যাথোড রশ্মি সাধারণ আলোক রশ্মির মতো নয়, কিন্তু আলোর মতোই সরলরেখায় চলে। এই রশ্মির গতিপথে কোনো অস্বচ্ছ বস্তু রাখলে তার পিছনে স্পষ্ট ছায়া তৈরি হয়।
(2) ক্যাথোড রশ্মি কণা ধর্ম বা জাড্য ধর্ম দেখায়। এর গতিপথে অভ্রের পাতলা পাত দিয়ে তৈরি হালকা পাখা রাখলে, চাকাটি ঘুরতে থাকে।
(3) মোক্ষণ নলটির বাইরে পজিটিভ চার্জযুক্ত প্লেট রাখলে, ক্যাথোড রশ্মি ওই প্লেটের দিকে বেঁকে যায়। তাই বলা যায়, ক্যাথোড রশ্মি নেগেটিভ চার্জযুক্ত কণার স্রোত।
(4) মোক্ষণ নলটির বাইরে কোনো চুম্বকের উত্তরমেরুকে কাছে আনলে ক্যাথোড রশ্মি সেই দিকে বেঁকে যায়।
(5) মোক্ষণ নলের ভিতরে কোন্ গ্যাস নেওয়া হয়েছে বা কোন্ ধাতুর ক্যাথোড নেওয়া হয়েছে তার উপর ক্যাথোড রশ্মির এই প্রকৃতি নির্ভর করে না। এর থেকেই সিদ্ধান্ত করা যায় ক্যাথোড রশ্মির উপাদান কণিকা সমস্ত পদার্থের মধ্যেই আছে এবং এরা পরমাণুর অন্তর্গত সাব-অ্যাটমিক কণিকা।
বিজ্ঞানী স্টোনি কোনো পরমাণুর এই প্রাথমিক কণিকাগুলির প্রথম নাম দেন "ইলেকট্রন"। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী মিলিক্যান এই ইলেকট্রনের আধানের মান নির্ণয় করেন। এই ইলেকট্রন কণিকা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী জে. জে. থমসনকে 1906 খ্রীষ্টাব্দে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়।
এই ইলেকট্রন কণিকা আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীদের ধারণা এল পরমাণুতে নেগেটিভ চার্জযুক্ত কণিকা থাকা সত্ত্বেও পরমাণু নিস্তড়িৎ হয় কীভাবে? তাহলে নিশ্চই পরমাণুর অভ্যন্তরে পজিটিভ চার্জযুক্ত কোনো কণিকা আছে। এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু হয়েছিল নানা পরীক্ষা। অবশেষে ধনাত্বক রশ্মির আবিষ্কারে এই প্রশ্নের উত্তর মেলে।
[1886 খ্রীষ্টাব্দ]
ধনাত্বক রশ্মির আবিষ্কার:
1886 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী গোল্ডস্টাইন তড়িৎমোক্ষণ নলে ছিদ্রযুক্ত ক্যাথোড ব্যবহার করে দেখতে পেলেন খুব কম চাপ ও উচ্চবিভব প্রভেদ প্রয়োগ করলে ক্যাথোড রশ্মির বিপরীত অভিমুখী একপ্রকার রশ্মি অ্যানোডের দিক থেকে এসে ক্যাথোডের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই রশ্মি ক্যাথোডের পিছনে মোক্ষণ নলের ভিতরের গায়ে লাগানো ফসফোর জাতীয় পদার্থে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে। এর পূর্বে কেবলমাত্র ইলেকট্রন ফসফোরের উপর পড়লে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করত, কিন্তু এক্ষেত্রেও প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করেছে। এই রশ্মি অ্যানোড থেকে নির্গত হয় বলে একে অ্যানোড রশ্মি (Anode Ray) বা ক্যানাল রশ্মি (Canal Ray) বলে।
এই রশ্মি সম্পর্কে যে যে বৈশিষ্ট্য গুলি পাওয়া গিয়েছিল তা হল:
(1) তড়িৎ বা চৌম্বকক্ষেত্রে এই রশ্মির বিক্ষেপণের ধরন দেখে প্রমানিত হয় এই রশ্মি ধনাত্বক আধানবাহী।
(2) অ্যানোড রশ্মি গঠনকারী কণার ভর, ইলেকট্রনের ভরের চেয়ে অনেক বেশি।
(3) এই কণার \(\frac{e}{m}\) অর্থাৎ আধান ও ভরের অনুপাত মোক্ষণ নলে ব্যবহৃত গ্যাসের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে এই \(\frac{e}{m}\) এর মান সর্বাধিক।
(4) এই রশ্মিগুলি ছিল পজিটিভ চার্জযুক্ত কণার স্রোত। কারণ এই কণাগুলি নলের বাইরে রাখা নেগেটিভ চার্জযুক্ত প্লেট রাখলে তার দিকে বেঁকে যায়। এদের প্রথমে একাধিক নাম দেওয়া হয়েছিল। ক্যানাল রশ্মি, অ্যানোড রশ্মি ইত্যাদি।
এই তড়িৎমোক্ষণ নলে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করলে, ক্যাথোড রশ্মির সাথে সংঘর্ষ হয় এবং \({H^ + }\) অর্থাৎ ইলেকট্রন বর্জিত পরমাণুর সৃষ্টি হয়। একেই আমরা প্রোটন বলি। তড়িৎমোক্ষণ নলে বিভিন্ন গ্যাস ব্যবহার করে দেখা গেছে \({H^ + }\) এর চেয়ে কম ভরের পজিটিভ চার্জযুক্ত কণা আর পাওয়া যায় না। অন্য যেসব পজিটিভ কণা পাওয়া যায়, তাদের ভর এই \({H^ + }\) (প্রোটন) এর ভরের পূর্ণসংখ্যার সরল গুনিতক হয়। তাই ইলেকট্রন ছাড়া পরমাণুর মধ্যে থাকা আর একটি মুল কণিকা হল প্রোটন।
[1896 খ্রীষ্টাব্দ] পদার্থের তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কার:
1896 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী হেনরি বেকারেল ইউরেনিয়ামের একটি লবনকে (পটাশিয়াম ইউরেনিল সালফেট) একটি মোটা কালো কাগজে মুড়ে একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর রেখে দেন। কয়েকদিন পর তিনি দেখেছিলেন ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর ওই লবনের একটি ছবি ফুটে উঠেছে। তিনি ভাবতে থাকেন এটি কীভাবে সম্ভব হল?
পরে তিনি একটি সিদ্ধান্তে অাসেন যে, ওই লবণ থেকে একটি অদৃশ্য রশ্মি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবসময় নির্গত হয় যা ফটোগ্রাফিক প্লেটকে আক্রান্ত করে। এই রশ্মির নাম দেওয়া হয় তেজস্ক্রিয় রশ্মি (Radioactive Ray)। ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি উচ্চ আণবিক ভরবিশিষ্ট মৌল ও ওই জাতীয় মৌলের যৌগবদ্ধ অবস্থায় থাকা পদার্থ থেকে এই তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের ঘটনাকে তেজস্ক্রিয়তা বলে (Radioactivity)। এই তেজস্ক্রিয় রশ্মিগুলি নির্গত হলে নতুন নতুন পদার্থের সৃষ্টি হয়।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই রশ্মিতে তিন রকমের কণিকা থাকে। (i) আলফা রশ্মি (\(\alpha \)) (ii) বিটা রশ্মি (\(\beta \)) (iii) গামা রশ্মি (\(\gamma \))।
আলফা রশ্মি: প্রতিটি আলফা কণিকার (\(\alpha \)) ভর 4 একক এবং আধান +2 একক। অর্থাৎ আলফা রশ্মি হল ধনাত্বক আধানযুক্ত হিলিয়াম কণিকার স্রোত।
বিটা রশ্মি: প্রতিটি বিটা কণিকার (\(\beta \)) ভর একটি ইলেকট্রনের ভরের সমান এবং আধানের মান -1 একক।
গামা রশ্মি: গামা রশ্মি (\(\gamma \)) ভরহীন এবং নিস্তড়িৎ প্রকৃতির বিকিরণ।
এই তেজস্ক্রিয়তা অাবিষ্কারের পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে:
(1) তেজস্ক্রিয়তা মৌলের পারমাণবিক বৈশিষ্ট্য।
(2) পরমাণুর যে স্থান থেকে এই রশ্মি নির্গত হয় তা হল পরমাণুর কেন্দ্রক।
(3) ভারী মৌলের পরমাণুর কেন্দ্রক ভঙ্গুর প্রকৃতির।
(4) তৈজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে পদার্থটি অন্য মৌলে রূপান্তরিত হয়।
(5) পরমাণুর কেন্দ্রক ভেঙেই এই আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি নির্গত হয়।
এই তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারে বোঝা যায় এই সমস্ত কণিকা (আলফা, বিটা, গামা) ও রশ্মি গুলি সবই পরমাণু থেকেই নির্গত হয় এবং পরমাণুর কেন্দ্রকের ভাঙনের ফলেই উৎপন্ন হয়।
এখন প্রশ্ন আসে কোনো পরমাণুর অভ্যন্তরে এই ধনাত্বক আধান বিশিষ্ট প্রোটন কণা ও ঋনাত্বক আধান বিশিষ্ট ইলেকট্রন কণিকা কীভাবে অবস্থান করে। কোনো পরমাণুর অভ্যন্তরে এই প্রোটন ও ইলেকট্রনের অবস্থান ও সজ্জা নিয়ে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী জে. জে. থমসন একটি ধারণা উপস্থাপনা করেন, যা থমসনের পরমানু মডেল (Thomson Atomic Model) নামে খ্যাত।
[1897 খ্রীষ্টাব্দ] J. J. Thomson এর পরমাণু মডেল:
ইলেকট্রন ও প্রোটন কণা আবিষ্কারের পর কোনো পরমাণুর মধ্যে এই আহিত কণিকাগুলি কিভাবে বিন্যস্ত থাকে সে বিষয়ে সে বিষয়ে 1897 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী জে. জে. থমসন (J. J. Thomson) একটি পরমাণুর মডেলের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন:
(1) পরমাণু একটি প্রায় \({10^{ - 10}}\) m ব্যাসের ধনাত্বক আধানযুক্ত একটি সুষম গোলক যার মধ্যে ধনাত্বক আধান সর্বত্র সুষমভাবে ছড়ানো থাকে। এবং পরমাণুর সমস্ত ভর সুষমভাবে ছড়িয়ে থাকে।
(2) এই ধনাত্বক আধানে আহিত গোলকটির মধ্যে ঋণাত্বক আধানবিশিষ্ট ইলেকট্রনগুলি এমনভাবে বণ্টিত থাকে যে ধনাত্বক আধানগুলির পারষ্পরিক বিকর্ষণ বল, এদের ঋণাত্বক তড়িৎ ও পরমাণুর ধনাত্বক তড়িতের আকর্ষণ বলের সমান হয়।
(3) অর্থাৎ থমসনের পরমাণু মডেল ঠিক পুডিং এর ন্যায় যেখানে কিশমিশগুলি পুডিং এর ভেতরে সুসমঞ্জস্য ভাবে আটকে থাকে। এখানে পুডিং যেন ঠিক ধনাত্বক আধান ও কিশমিশ গুলি হল ঋণাত্বক আধান সম্পন্ন ইলেকট্রন।
থমসনের প্রস্তাবিত এই পরমাণুর মডেলটিকে পাম-পুডিং মডেল (Plum-pudding Model) বলে।
থমসনের পরমাণু মডেলের সাফল্য (Success):
থমসনের প্রস্তাবিত পরমাণু মডেল থেকে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক ঘটনা যেমন (i) তাপীয় আয়ন নিঃসরণ (Thermionic Emission ) (ii) আলোক তড়িৎ ক্রিয়া (Photo-electric Effect) (iii) আয়নীকরণ প্রক্রিয়া (Ionization Process) ইত্যাদি ঘটনার ব্যাখ্যা সুন্দর ভাবে দেওয়া যায়।
থমসনের পরমাণু মডেলের ব্যর্থতা (Failure):
থমসনের পরমাণু মডেল থেকে (i) \(\alpha \) কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষা (Scattering of \(\alpha \) particle ) (ii) হাইড্রোজেন বা হাইড্রোজেনের সদৃশ পরমাণুর বর্ণালী (Spectral line) সৃষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই মডেলের ভিত্তি ছিল শুধুমাত্র ধনাত্বক ও ঋণাত্বক তড়িতের প্রশমতা সম্পর্কিত, তাই এই মডেল সর্বজনগ্রাহ্য হয় নি।
[1911 খ্রীষ্টাব্দ] রাদারফোর্ডের \(\alpha \) কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষা ও পরমাণুর যথার্থ প্রতিরূপ আবিষ্কার:
1911 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী আর্নেষ্ট রাদারফোর্ড 0.0004 mm পুরু সোনার পাতের উপর \(\alpha \) কণা দিয়ে আঘাত করে দেখেন যে:
(i) বেশির ভাগ \(\alpha \) কণাই সরাসরি সোনার পাত ভেদ করে চলে যায়।
(ii) কিছু সংখ্যক \(\alpha \) কণা বিভিন্ন কোণে বিক্ষিপ্ত হয়।
(iii) অতি অল্প সংখ্যক \(\alpha \) কণা (প্রায় 20,000 এর মধ্যে 1 টি) সোনার পাতে ধাক্কা খেয়ে \(90^\circ \) বা তার চেয়ে বেশি কোণে ফিরে আসে।
(iii) দু-একটি কণা (প্রায় 1,00,000 এর মধ্যে 1 টি) \(180^\circ \) কোণে বিচ্যুত হয়ে ফিরে আসে।
এই পরীক্ষালব্ধ ফল থেকে রাদারফোর্ড সিদ্ধান্তে আসেন যে
(i) পরমাণুর বেশিরভাগ স্থানই ফাঁকা।
(ii) পরমাণু নিরেট নয়।
(iii) পরমাণুতে সমস্ত ধনাত্বক আধান ছড়িয়ে থাকে না, এখানে ধনাত্বক আধানগুলি পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে অতিক্ষুদ্র স্থানে অবস্থান করে। এবং তার বাইরে ঋণাত্বক ইলেকট্রনগুলি অবস্থান করে।
(iv) তাই পরমাণুর দুটি অংশ - নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন মহল।
(v) নিউক্লিয়াসের আয়তন অতি ক্ষুদ্র।
(vi) নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রনগুলি বিভিন্ন কক্ষপথে K, L, M, ... আবর্তন করে।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের ত্রুটি:
(i) রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে নিউট্রনের অস্থিত্ব জানা ছিল না।
(ii) এই মডেলে পরমাণুর স্থায়িত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারে না। কারণ এক্সেত্রে ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারিদিকে আবর্তন করলে, ইলেকট্রনগুলি থেকে অনবরত শক্তি বিকিরণ হতে থাকবে। এই শক্তি বিকিরণের ফলে ইলেকট্রনের বেগ ক্রমশ কমতে থাকবে এবং কক্ষপথের ব্যাসার্ধ্যের মানও ক্রমশ কমতে কমতে একসময় নিউক্লিয়াসের উপর আছড়ে পড়বে। সুতরাং পরমাণুর অস্থিত্ব নষ্ট হবে। কিন্তু বাস্তবে সুস্থিত পরমানু পাওয়া যায়।
(iii) ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনগুলি থেকে অবিরাম শক্তি বিকিরণের করলে যে বর্ণালী পাওয়া যায় তা নিরবচ্ছিন্ন হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় পারমাণবিক বর্ণালী বিচ্ছিন্ন বা রেখা বর্ণালী হয়।
(iv) রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সাহায্যে নিউক্লিয়াসের বাইরের ইলেকট্রন মহলে ইলেকট্রনগুলির বণ্টন সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের মুল ভিত্তি ছিল নিউটনের সনাতনী পদার্থবিদ্যার ধারণা।
[1913 খ্রীষ্টাব্দ] নীলস বোরের পরমাণু মডেল:
1913 খ্রীষ্টাব্দে ডেনমার্কের বিজ্ঞানী নীলস বোর, রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলটিকে সংশোধন করেন। তাই নীলস্ বোরের পরমাণু মডেলটি হল রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সংশোধিত ও বর্ধিত রূপ। এই মডেলে পরমাণুর স্থায়িত্ব বিবেচনা করা হয়েছে। এই মডেলে পরমাণুর মধ্যে (i) ইলেকট্রন মহল এবং (ii) নিউক্লিয়াসের ধারণা বজায় রয়েছে। কিন্তু এই মডেলেও নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের অস্থিত্বের কথা বলা হয় নি। এখানে ইলেকট্রনের কক্ষপথ গুলিকে বৃত্তাকার বলেই ধরা হয়।
এটি পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল। এই মডেল অনুসারে ইলেকট্রন, নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে যেকোনো ব্যাসার্ধ্যের বৃত্তাকার কক্ষপথে আবর্তন করতে পারে না। ইলেকট্রনগুলি কয়েকটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধ্যের বৃত্তাকার কক্ষপথেই আবর্তন করবে এবং এই কক্ষপথগুলিতে ইলেকট্রনের আবর্তনের জন্যও শক্তি নির্দিষ্ট করা থাকে। এই কক্ষপথগুলিকে কোয়ান্টাম কক্ষপথ বলে। এই কক্ষপথগুলিতে ইলেকট্রনের আবর্তন চলাকালীন কোনো শক্তি বা বিকিরণ নির্গত হবে না। কেবলমাত্র ইলেকট্রনগুলি কক্ষপথ পরিবর্তন করলেই বিকিরণ নির্গত হবে। এই মডেলে পরমাণুর সুস্থিতি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে।
[1913 খ্রীষ্টাব্দ] মোজলের পরীক্ষা:
1913 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী মোজলে X রশ্মি বর্ণালী পরীক্ষাটি করেন। এতে জানা যায় কোন পরমাণুতে কয়টি করে প্রোটন আছে। অর্থাৎ মৌলের পরমাণু ক্রমাঙ্ক বা পারমাণবিক সংখ্যা নির্ণয় করা যায় এবং নিউক্লিয়াসের মোট তড়িতাধান নির্ণয় করা যায়।
[1915 খ্রীষ্টাব্দ] বোর-সোমারফিল্ড পরমাণুর মডেল:
1915 খ্রীষ্টাব্দে বোর-সোমারফিল্ড পরমাণু মডেল প্রকাশিত হয়। এখানে ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলিকে বৃত্তাকার ও উপবৃত্তাকার উভয় প্রকার সম্ভব বলা হয়েছে। কক্ষপথগুলি বিভিন্ন তলে অবস্থান করে। এখানেও নিউট্রনের কথা উল্লেখ করা হয় নি।
পূর্ববর্তী মডেলগুলির ন্যায় এটিও পরমাণুর ত্রিমাত্রিক ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণা অবতরণ করার জন্য পরীক্ষালব্ধ বর্ণালীগুলির সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারা যায়।
[1920 খ্রীষ্টাব্দ] রাদারফোর্ডের একটি ধারণা:
1920 খ্রীষ্টাব্দে রাদারফোর্ড একটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন যে পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটন ছাড়া অন্য কোনো নিস্তড়িৎ কণা থাকতে পারে। কারণ মৌলিক পদার্থের একটি পরমাণুর ওজন তার মধ্যে থাকা ইলেকট্রন ও প্রোটনের যোগফলের সমান হওয়া উচিত। আবার ইলেকট্রনের ভর অতি নগন্য হওয়ায় মৌলগুলির পরমাণুর ভর প্রোটনগুলির ভরের সমান হওয়া উচিত।
কিন্তু সাধারণ হাইড্রোজেন বাদে অন্য সমস্ত মৌলের পরমাণুর ভর তাদের নিজেদের প্রোটনের ভরের থেকে বেশি হয়। যেমন, Na পরমাণুর পারমানবিক ভর 23 অর্থাৎ একটি সোডিয়াম পরমাণু একটি প্রোটন কণার চেয়ে 23 গুণ ভারী। কিন্তু মোজলের পরীক্ষা থেকে জানা গেছে Na পরমাণুতে 11 টি প্রোটন আছে। তাহলে বাকী 11 একক ভর কোথা থেকে এল?
তাই তিনি অনুমান করেছিলেন এদের পরমাণুতে চার্জবিহীন নিশ্চই কোনো কণা আছে যার ভর প্রোটনের ভরের প্রায় কাছাকাছি।
[1932 খ্রীষ্টাব্দ] নিউট্রন আবিষ্কার:
অবশেষে 1932 খ্রীষ্টাব্দে রাদারফোর্ডের ছাত্র বিজ্ঞানী স্যাডউইক নিউট্রন কণা আবিষ্কার করেন। তিনি হালকা ধাতু বেরিলিয়ামকে \(\alpha \) কণা দ্বারা আঘাত করে এক ধরণের নিস্তড়িৎ কণার সন্ধান পান। এর ভর প্রোটনের ভরের তুলনায় সামান্য বেশি। এবং এই কণাটিও পরমাণুর কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াসে অবস্থিত। এই কণাগুলির ভর ও প্রোটনের ভর যোগ করলে মোটামুটি পরমাণুর ভর মিলে যায় এবং ভর সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়।
এই একই পরীক্ষা বিজ্ঞানী বুথে ও বেকার সম্পন্ন করেছিলেন 1931 খ্রীষ্টাব্দে কিন্তু এই বিজ্ঞানীদ্বয় নিউট্রন কণাকে \(\gamma \) রশ্মি মনে করে ভুল করেছিলেন। বিজ্ঞানী স্যাডউইকের পরীক্ষালব্ধ ফলগুলি হল:
(i) পরমাণুর কেন্দ্রে নিউট্রন কণা অবস্থান করে।
(ii) নিউট্রনের ভর প্রোটনের ভরের চেয়ে সামান্য বেশি।
(iii) নিউট্রন হল একটি মৌল কণা।
(iv) নিউট্রন একটি আধানবিহীন কণিকা।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ডালটনের পরমাণুবাদ ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ। আমরা যদি পরমাণু গঠনের কালানুক্রমিক সংক্ষিপ্তসার দেখি তাহলে বুঝতে পারব যে 1808 সালে ডালটনের পরমাণুবাদ আবিষ্কৃত হয় এবং তারপর আরও 70 বছর পর অর্থাৎ 1878 সালে ইলেকট্রন আবিষ্কৃত হয়। তৎকালীন বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের ভিত্তিতে ডালটনের পরমাণুবাদ রচনা, বিজ্ঞানের উন্নতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানীরা আজ আরও ছোটো কণা ইলেকট্রন, প্রোটন সৃষ্টি করেন। তাই ডালটনের পরমাণুবাদই পরমাণু গঠনের প্রথম সোপান বলা যেতে পারে।
পরমানু বিজ্ঞানীদের কাছে অদৃশ্য। এই অদৃশ্য বস্তুর ধারণাও বিজ্ঞানীদের কাছে খুব কঠিন। ফলে বিজ্ঞানীর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন মডেল সংযুক্ত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী আইনষ্টাইনের সেই বিখ্যাত উক্তি -
"তোমরা দূর থেকে মনে করো যে, আমি পরিতৃপ্তির সঙ্গে আমার বিগত জীবনের কাজের কথা চিন্তা করি। কিন্তু কাছ থেকে সবকিছু অন্যরকম দেখায়। এমন একটিও বৈজ্ঞানিক ধারণা নেই যার সম্বন্ধে আমার দৃঢ় প্রত্যয় আছে যে, সেটি চিরকাল অবিচল থাকবে।"
বর্তমানে পরমাণুর মধ্যে প্রায় 35 রকমের কণার সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এখানে কয়েকটির নাম উল্লেখ করা হল।
স্থায়ী কণা (Stable Particle): (i) ইলেকট্রন, (ii) প্রোটন (iii), নিউট্রন
অস্থায়ী কণা (Unstable Particle): (i) পজিট্রন (ii) মেসন (iii) নিউট্রিনো (iv) অ্যান্টি-নিউট্রিনো (v) অ্যান্টি-প্রোটন
সংমিশ্র কণা (Composite Particle): (i) ডয়টেরন (ii) আলফা কণা ইত্যাদি
জেনে রাখো: বর্তমানে প্রোটনকে মৌল কণা হিসাবে গৌণ করা হয়, কিন্তু এই প্রোটন কণা আবার কোয়ার্ক (Quark) নামে কয়েকটি সূক্ষ সূক্ষ কণা দ্বারা গঠিত।
[1878 খ্রীষ্টাব্দ]
ক্যাথোড রশ্মির আবিষ্কার:
বিজ্ঞানী প্লুকার (1858) ও গোল্ডস্টাইন (1876) তড়িৎমোক্ষণ নল (Discharge Tube) নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। অবশেষে 1878 খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম ক্রুক্স তড়িৎমোক্ষন নলের অভ্যন্তরের বায়ুর চাপ 0.01 mm - 0.001 mm রেখে উচ্চবিভব প্রভেদ প্রায় 10,000 volt বিভবপ্রভেদ প্রয়োগ করে তড়িৎমোক্ষণ নলে ক্যাথোড রশ্মি তৈরি করেন। তিনি দেখেন ক্যাথোড পাত থেকে একপ্রকার অদৃশ্য রশ্মি লম্বভাবে নির্গত হয়ে দ্রুতগতিতে অ্যানোড পাতের দিকে যাচ্ছে এবং অ্যানোডের চারপাশের দেওয়ালে রঙিন প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করছে। ক্যাথোড থেকে এই রশ্মি নির্গত হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে এই রশ্মির নাম দেওয়া হয়েছিল "ক্যাথোড রশ্মি (Cathode Ray)"।
[1878 খ্রীষ্টাব্দ] ক্যাথোড রশ্মির ধারণা থেকে ইলেকট্রনের অস্থিত্বের প্রমাণ:
1897 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী জে. জে. থমসন এবং বিজ্ঞানী স্টোনি এই ক্যাথোড রশ্মির উপর বিস্তৃত গবেষণা করেন। তাঁদের গবেষণায় ক্যাথোড রশ্মি থেকে যে যে বৈশিষ্ট্য বা তথ্যগুলি পাওয়া গিয়েছিল তা হল:
(1) ক্যাথোড রশ্মি সাধারণ আলোক রশ্মির মতো নয়, কিন্তু আলোর মতোই সরলরেখায় চলে। এই রশ্মির গতিপথে কোনো অস্বচ্ছ বস্তু রাখলে তার পিছনে স্পষ্ট ছায়া তৈরি হয়।
(2) ক্যাথোড রশ্মি কণা ধর্ম বা জাড্য ধর্ম দেখায়। এর গতিপথে অভ্রের পাতলা পাত দিয়ে তৈরি হালকা পাখা রাখলে, চাকাটি ঘুরতে থাকে।
(3) মোক্ষণ নলটির বাইরে পজিটিভ চার্জযুক্ত প্লেট রাখলে, ক্যাথোড রশ্মি ওই প্লেটের দিকে বেঁকে যায়। তাই বলা যায়, ক্যাথোড রশ্মি নেগেটিভ চার্জযুক্ত কণার স্রোত।
(4) মোক্ষণ নলটির বাইরে কোনো চুম্বকের উত্তরমেরুকে কাছে আনলে ক্যাথোড রশ্মি সেই দিকে বেঁকে যায়।
(5) মোক্ষণ নলের ভিতরে কোন্ গ্যাস নেওয়া হয়েছে বা কোন্ ধাতুর ক্যাথোড নেওয়া হয়েছে তার উপর ক্যাথোড রশ্মির এই প্রকৃতি নির্ভর করে না। এর থেকেই সিদ্ধান্ত করা যায় ক্যাথোড রশ্মির উপাদান কণিকা সমস্ত পদার্থের মধ্যেই আছে এবং এরা পরমাণুর অন্তর্গত সাব-অ্যাটমিক কণিকা।
বিজ্ঞানী স্টোনি কোনো পরমাণুর এই প্রাথমিক কণিকাগুলির প্রথম নাম দেন "ইলেকট্রন"। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী মিলিক্যান এই ইলেকট্রনের আধানের মান নির্ণয় করেন। এই ইলেকট্রন কণিকা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী জে. জে. থমসনকে 1906 খ্রীষ্টাব্দে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়।
এই ইলেকট্রন কণিকা আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীদের ধারণা এল পরমাণুতে নেগেটিভ চার্জযুক্ত কণিকা থাকা সত্ত্বেও পরমাণু নিস্তড়িৎ হয় কীভাবে? তাহলে নিশ্চই পরমাণুর অভ্যন্তরে পজিটিভ চার্জযুক্ত কোনো কণিকা আছে। এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু হয়েছিল নানা পরীক্ষা। অবশেষে ধনাত্বক রশ্মির আবিষ্কারে এই প্রশ্নের উত্তর মেলে।
[1886 খ্রীষ্টাব্দ]
ধনাত্বক রশ্মির আবিষ্কার:
1886 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী গোল্ডস্টাইন তড়িৎমোক্ষণ নলে ছিদ্রযুক্ত ক্যাথোড ব্যবহার করে দেখতে পেলেন খুব কম চাপ ও উচ্চবিভব প্রভেদ প্রয়োগ করলে ক্যাথোড রশ্মির বিপরীত অভিমুখী একপ্রকার রশ্মি অ্যানোডের দিক থেকে এসে ক্যাথোডের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই রশ্মি ক্যাথোডের পিছনে মোক্ষণ নলের ভিতরের গায়ে লাগানো ফসফোর জাতীয় পদার্থে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে। এর পূর্বে কেবলমাত্র ইলেকট্রন ফসফোরের উপর পড়লে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করত, কিন্তু এক্ষেত্রেও প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করেছে। এই রশ্মি অ্যানোড থেকে নির্গত হয় বলে একে অ্যানোড রশ্মি (Anode Ray) বা ক্যানাল রশ্মি (Canal Ray) বলে।
এই রশ্মি সম্পর্কে যে যে বৈশিষ্ট্য গুলি পাওয়া গিয়েছিল তা হল:
(1) তড়িৎ বা চৌম্বকক্ষেত্রে এই রশ্মির বিক্ষেপণের ধরন দেখে প্রমানিত হয় এই রশ্মি ধনাত্বক আধানবাহী।
(2) অ্যানোড রশ্মি গঠনকারী কণার ভর, ইলেকট্রনের ভরের চেয়ে অনেক বেশি।
(3) এই কণার \(\frac{e}{m}\) অর্থাৎ আধান ও ভরের অনুপাত মোক্ষণ নলে ব্যবহৃত গ্যাসের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে এই \(\frac{e}{m}\) এর মান সর্বাধিক।
(4) এই রশ্মিগুলি ছিল পজিটিভ চার্জযুক্ত কণার স্রোত। কারণ এই কণাগুলি নলের বাইরে রাখা নেগেটিভ চার্জযুক্ত প্লেট রাখলে তার দিকে বেঁকে যায়। এদের প্রথমে একাধিক নাম দেওয়া হয়েছিল। ক্যানাল রশ্মি, অ্যানোড রশ্মি ইত্যাদি।
এই তড়িৎমোক্ষণ নলে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করলে, ক্যাথোড রশ্মির সাথে সংঘর্ষ হয় এবং \({H^ + }\) অর্থাৎ ইলেকট্রন বর্জিত পরমাণুর সৃষ্টি হয়। একেই আমরা প্রোটন বলি। তড়িৎমোক্ষণ নলে বিভিন্ন গ্যাস ব্যবহার করে দেখা গেছে \({H^ + }\) এর চেয়ে কম ভরের পজিটিভ চার্জযুক্ত কণা আর পাওয়া যায় না। অন্য যেসব পজিটিভ কণা পাওয়া যায়, তাদের ভর এই \({H^ + }\) (প্রোটন) এর ভরের পূর্ণসংখ্যার সরল গুনিতক হয়। তাই ইলেকট্রন ছাড়া পরমাণুর মধ্যে থাকা আর একটি মুল কণিকা হল প্রোটন।
[1896 খ্রীষ্টাব্দ] পদার্থের তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কার:
1896 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী হেনরি বেকারেল ইউরেনিয়ামের একটি লবনকে (পটাশিয়াম ইউরেনিল সালফেট) একটি মোটা কালো কাগজে মুড়ে একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর রেখে দেন। কয়েকদিন পর তিনি দেখেছিলেন ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর ওই লবনের একটি ছবি ফুটে উঠেছে। তিনি ভাবতে থাকেন এটি কীভাবে সম্ভব হল?
পরে তিনি একটি সিদ্ধান্তে অাসেন যে, ওই লবণ থেকে একটি অদৃশ্য রশ্মি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবসময় নির্গত হয় যা ফটোগ্রাফিক প্লেটকে আক্রান্ত করে। এই রশ্মির নাম দেওয়া হয় তেজস্ক্রিয় রশ্মি (Radioactive Ray)। ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি উচ্চ আণবিক ভরবিশিষ্ট মৌল ও ওই জাতীয় মৌলের যৌগবদ্ধ অবস্থায় থাকা পদার্থ থেকে এই তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের ঘটনাকে তেজস্ক্রিয়তা বলে (Radioactivity)। এই তেজস্ক্রিয় রশ্মিগুলি নির্গত হলে নতুন নতুন পদার্থের সৃষ্টি হয়।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই রশ্মিতে তিন রকমের কণিকা থাকে। (i) আলফা রশ্মি (\(\alpha \)) (ii) বিটা রশ্মি (\(\beta \)) (iii) গামা রশ্মি (\(\gamma \))।
আলফা রশ্মি: প্রতিটি আলফা কণিকার (\(\alpha \)) ভর 4 একক এবং আধান +2 একক। অর্থাৎ আলফা রশ্মি হল ধনাত্বক আধানযুক্ত হিলিয়াম কণিকার স্রোত।
বিটা রশ্মি: প্রতিটি বিটা কণিকার (\(\beta \)) ভর একটি ইলেকট্রনের ভরের সমান এবং আধানের মান -1 একক।
গামা রশ্মি: গামা রশ্মি (\(\gamma \)) ভরহীন এবং নিস্তড়িৎ প্রকৃতির বিকিরণ।
এই তেজস্ক্রিয়তা অাবিষ্কারের পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে:
(1) তেজস্ক্রিয়তা মৌলের পারমাণবিক বৈশিষ্ট্য।
(2) পরমাণুর যে স্থান থেকে এই রশ্মি নির্গত হয় তা হল পরমাণুর কেন্দ্রক।
(3) ভারী মৌলের পরমাণুর কেন্দ্রক ভঙ্গুর প্রকৃতির।
(4) তৈজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে পদার্থটি অন্য মৌলে রূপান্তরিত হয়।
(5) পরমাণুর কেন্দ্রক ভেঙেই এই আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি নির্গত হয়।
এই তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারে বোঝা যায় এই সমস্ত কণিকা (আলফা, বিটা, গামা) ও রশ্মি গুলি সবই পরমাণু থেকেই নির্গত হয় এবং পরমাণুর কেন্দ্রকের ভাঙনের ফলেই উৎপন্ন হয়।
এখন প্রশ্ন আসে কোনো পরমাণুর অভ্যন্তরে এই ধনাত্বক আধান বিশিষ্ট প্রোটন কণা ও ঋনাত্বক আধান বিশিষ্ট ইলেকট্রন কণিকা কীভাবে অবস্থান করে। কোনো পরমাণুর অভ্যন্তরে এই প্রোটন ও ইলেকট্রনের অবস্থান ও সজ্জা নিয়ে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী জে. জে. থমসন একটি ধারণা উপস্থাপনা করেন, যা থমসনের পরমানু মডেল (Thomson Atomic Model) নামে খ্যাত।
[1897 খ্রীষ্টাব্দ] J. J. Thomson এর পরমাণু মডেল:
ইলেকট্রন ও প্রোটন কণা আবিষ্কারের পর কোনো পরমাণুর মধ্যে এই আহিত কণিকাগুলি কিভাবে বিন্যস্ত থাকে সে বিষয়ে সে বিষয়ে 1897 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী জে. জে. থমসন (J. J. Thomson) একটি পরমাণুর মডেলের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন:
(1) পরমাণু একটি প্রায় \({10^{ - 10}}\) m ব্যাসের ধনাত্বক আধানযুক্ত একটি সুষম গোলক যার মধ্যে ধনাত্বক আধান সর্বত্র সুষমভাবে ছড়ানো থাকে। এবং পরমাণুর সমস্ত ভর সুষমভাবে ছড়িয়ে থাকে।
(2) এই ধনাত্বক আধানে আহিত গোলকটির মধ্যে ঋণাত্বক আধানবিশিষ্ট ইলেকট্রনগুলি এমনভাবে বণ্টিত থাকে যে ধনাত্বক আধানগুলির পারষ্পরিক বিকর্ষণ বল, এদের ঋণাত্বক তড়িৎ ও পরমাণুর ধনাত্বক তড়িতের আকর্ষণ বলের সমান হয়।
(3) অর্থাৎ থমসনের পরমাণু মডেল ঠিক পুডিং এর ন্যায় যেখানে কিশমিশগুলি পুডিং এর ভেতরে সুসমঞ্জস্য ভাবে আটকে থাকে। এখানে পুডিং যেন ঠিক ধনাত্বক আধান ও কিশমিশ গুলি হল ঋণাত্বক আধান সম্পন্ন ইলেকট্রন।
থমসনের প্রস্তাবিত এই পরমাণুর মডেলটিকে পাম-পুডিং মডেল (Plum-pudding Model) বলে।
থমসনের পরমাণু মডেলের সাফল্য (Success):
থমসনের প্রস্তাবিত পরমাণু মডেল থেকে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক ঘটনা যেমন (i) তাপীয় আয়ন নিঃসরণ (Thermionic Emission ) (ii) আলোক তড়িৎ ক্রিয়া (Photo-electric Effect) (iii) আয়নীকরণ প্রক্রিয়া (Ionization Process) ইত্যাদি ঘটনার ব্যাখ্যা সুন্দর ভাবে দেওয়া যায়।
থমসনের পরমাণু মডেলের ব্যর্থতা (Failure):
থমসনের পরমাণু মডেল থেকে (i) \(\alpha \) কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষা (Scattering of \(\alpha \) particle ) (ii) হাইড্রোজেন বা হাইড্রোজেনের সদৃশ পরমাণুর বর্ণালী (Spectral line) সৃষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই মডেলের ভিত্তি ছিল শুধুমাত্র ধনাত্বক ও ঋণাত্বক তড়িতের প্রশমতা সম্পর্কিত, তাই এই মডেল সর্বজনগ্রাহ্য হয় নি।
[1911 খ্রীষ্টাব্দ] রাদারফোর্ডের \(\alpha \) কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষা ও পরমাণুর যথার্থ প্রতিরূপ আবিষ্কার:
1911 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী আর্নেষ্ট রাদারফোর্ড 0.0004 mm পুরু সোনার পাতের উপর \(\alpha \) কণা দিয়ে আঘাত করে দেখেন যে:
(i) বেশির ভাগ \(\alpha \) কণাই সরাসরি সোনার পাত ভেদ করে চলে যায়।
(ii) কিছু সংখ্যক \(\alpha \) কণা বিভিন্ন কোণে বিক্ষিপ্ত হয়।
(iii) অতি অল্প সংখ্যক \(\alpha \) কণা (প্রায় 20,000 এর মধ্যে 1 টি) সোনার পাতে ধাক্কা খেয়ে \(90^\circ \) বা তার চেয়ে বেশি কোণে ফিরে আসে।
(iii) দু-একটি কণা (প্রায় 1,00,000 এর মধ্যে 1 টি) \(180^\circ \) কোণে বিচ্যুত হয়ে ফিরে আসে।
এই পরীক্ষালব্ধ ফল থেকে রাদারফোর্ড সিদ্ধান্তে আসেন যে
(i) পরমাণুর বেশিরভাগ স্থানই ফাঁকা।
(ii) পরমাণু নিরেট নয়।
(iii) পরমাণুতে সমস্ত ধনাত্বক আধান ছড়িয়ে থাকে না, এখানে ধনাত্বক আধানগুলি পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে অতিক্ষুদ্র স্থানে অবস্থান করে। এবং তার বাইরে ঋণাত্বক ইলেকট্রনগুলি অবস্থান করে।
(iv) তাই পরমাণুর দুটি অংশ - নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন মহল।
(v) নিউক্লিয়াসের আয়তন অতি ক্ষুদ্র।
(vi) নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রনগুলি বিভিন্ন কক্ষপথে K, L, M, ... আবর্তন করে।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের ত্রুটি:
(i) রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে নিউট্রনের অস্থিত্ব জানা ছিল না।
(ii) এই মডেলে পরমাণুর স্থায়িত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারে না। কারণ এক্সেত্রে ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারিদিকে আবর্তন করলে, ইলেকট্রনগুলি থেকে অনবরত শক্তি বিকিরণ হতে থাকবে। এই শক্তি বিকিরণের ফলে ইলেকট্রনের বেগ ক্রমশ কমতে থাকবে এবং কক্ষপথের ব্যাসার্ধ্যের মানও ক্রমশ কমতে কমতে একসময় নিউক্লিয়াসের উপর আছড়ে পড়বে। সুতরাং পরমাণুর অস্থিত্ব নষ্ট হবে। কিন্তু বাস্তবে সুস্থিত পরমানু পাওয়া যায়।
(iii) ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনগুলি থেকে অবিরাম শক্তি বিকিরণের করলে যে বর্ণালী পাওয়া যায় তা নিরবচ্ছিন্ন হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় পারমাণবিক বর্ণালী বিচ্ছিন্ন বা রেখা বর্ণালী হয়।
(iv) রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সাহায্যে নিউক্লিয়াসের বাইরের ইলেকট্রন মহলে ইলেকট্রনগুলির বণ্টন সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের মুল ভিত্তি ছিল নিউটনের সনাতনী পদার্থবিদ্যার ধারণা।
[1913 খ্রীষ্টাব্দ] নীলস বোরের পরমাণু মডেল:
1913 খ্রীষ্টাব্দে ডেনমার্কের বিজ্ঞানী নীলস বোর, রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলটিকে সংশোধন করেন। তাই নীলস্ বোরের পরমাণু মডেলটি হল রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সংশোধিত ও বর্ধিত রূপ। এই মডেলে পরমাণুর স্থায়িত্ব বিবেচনা করা হয়েছে। এই মডেলে পরমাণুর মধ্যে (i) ইলেকট্রন মহল এবং (ii) নিউক্লিয়াসের ধারণা বজায় রয়েছে। কিন্তু এই মডেলেও নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের অস্থিত্বের কথা বলা হয় নি। এখানে ইলেকট্রনের কক্ষপথ গুলিকে বৃত্তাকার বলেই ধরা হয়।
এটি পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল। এই মডেল অনুসারে ইলেকট্রন, নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে যেকোনো ব্যাসার্ধ্যের বৃত্তাকার কক্ষপথে আবর্তন করতে পারে না। ইলেকট্রনগুলি কয়েকটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধ্যের বৃত্তাকার কক্ষপথেই আবর্তন করবে এবং এই কক্ষপথগুলিতে ইলেকট্রনের আবর্তনের জন্যও শক্তি নির্দিষ্ট করা থাকে। এই কক্ষপথগুলিকে কোয়ান্টাম কক্ষপথ বলে। এই কক্ষপথগুলিতে ইলেকট্রনের আবর্তন চলাকালীন কোনো শক্তি বা বিকিরণ নির্গত হবে না। কেবলমাত্র ইলেকট্রনগুলি কক্ষপথ পরিবর্তন করলেই বিকিরণ নির্গত হবে। এই মডেলে পরমাণুর সুস্থিতি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে।
[1913 খ্রীষ্টাব্দ] মোজলের পরীক্ষা:
1913 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী মোজলে X রশ্মি বর্ণালী পরীক্ষাটি করেন। এতে জানা যায় কোন পরমাণুতে কয়টি করে প্রোটন আছে। অর্থাৎ মৌলের পরমাণু ক্রমাঙ্ক বা পারমাণবিক সংখ্যা নির্ণয় করা যায় এবং নিউক্লিয়াসের মোট তড়িতাধান নির্ণয় করা যায়।
[1915 খ্রীষ্টাব্দ] বোর-সোমারফিল্ড পরমাণুর মডেল:
1915 খ্রীষ্টাব্দে বোর-সোমারফিল্ড পরমাণু মডেল প্রকাশিত হয়। এখানে ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলিকে বৃত্তাকার ও উপবৃত্তাকার উভয় প্রকার সম্ভব বলা হয়েছে। কক্ষপথগুলি বিভিন্ন তলে অবস্থান করে। এখানেও নিউট্রনের কথা উল্লেখ করা হয় নি।
পূর্ববর্তী মডেলগুলির ন্যায় এটিও পরমাণুর ত্রিমাত্রিক ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণা অবতরণ করার জন্য পরীক্ষালব্ধ বর্ণালীগুলির সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারা যায়।
[1920 খ্রীষ্টাব্দ] রাদারফোর্ডের একটি ধারণা:
1920 খ্রীষ্টাব্দে রাদারফোর্ড একটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন যে পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটন ছাড়া অন্য কোনো নিস্তড়িৎ কণা থাকতে পারে। কারণ মৌলিক পদার্থের একটি পরমাণুর ওজন তার মধ্যে থাকা ইলেকট্রন ও প্রোটনের যোগফলের সমান হওয়া উচিত। আবার ইলেকট্রনের ভর অতি নগন্য হওয়ায় মৌলগুলির পরমাণুর ভর প্রোটনগুলির ভরের সমান হওয়া উচিত।
কিন্তু সাধারণ হাইড্রোজেন বাদে অন্য সমস্ত মৌলের পরমাণুর ভর তাদের নিজেদের প্রোটনের ভরের থেকে বেশি হয়। যেমন, Na পরমাণুর পারমানবিক ভর 23 অর্থাৎ একটি সোডিয়াম পরমাণু একটি প্রোটন কণার চেয়ে 23 গুণ ভারী। কিন্তু মোজলের পরীক্ষা থেকে জানা গেছে Na পরমাণুতে 11 টি প্রোটন আছে। তাহলে বাকী 11 একক ভর কোথা থেকে এল?
তাই তিনি অনুমান করেছিলেন এদের পরমাণুতে চার্জবিহীন নিশ্চই কোনো কণা আছে যার ভর প্রোটনের ভরের প্রায় কাছাকাছি।
[1932 খ্রীষ্টাব্দ] নিউট্রন আবিষ্কার:
অবশেষে 1932 খ্রীষ্টাব্দে রাদারফোর্ডের ছাত্র বিজ্ঞানী স্যাডউইক নিউট্রন কণা আবিষ্কার করেন। তিনি হালকা ধাতু বেরিলিয়ামকে \(\alpha \) কণা দ্বারা আঘাত করে এক ধরণের নিস্তড়িৎ কণার সন্ধান পান। এর ভর প্রোটনের ভরের তুলনায় সামান্য বেশি। এবং এই কণাটিও পরমাণুর কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াসে অবস্থিত। এই কণাগুলির ভর ও প্রোটনের ভর যোগ করলে মোটামুটি পরমাণুর ভর মিলে যায় এবং ভর সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়।
এই একই পরীক্ষা বিজ্ঞানী বুথে ও বেকার সম্পন্ন করেছিলেন 1931 খ্রীষ্টাব্দে কিন্তু এই বিজ্ঞানীদ্বয় নিউট্রন কণাকে \(\gamma \) রশ্মি মনে করে ভুল করেছিলেন। বিজ্ঞানী স্যাডউইকের পরীক্ষালব্ধ ফলগুলি হল:
(i) পরমাণুর কেন্দ্রে নিউট্রন কণা অবস্থান করে।
(ii) নিউট্রনের ভর প্রোটনের ভরের চেয়ে সামান্য বেশি।
(iii) নিউট্রন হল একটি মৌল কণা।
(iv) নিউট্রন একটি আধানবিহীন কণিকা।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ডালটনের পরমাণুবাদ ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ। আমরা যদি পরমাণু গঠনের কালানুক্রমিক সংক্ষিপ্তসার দেখি তাহলে বুঝতে পারব যে 1808 সালে ডালটনের পরমাণুবাদ আবিষ্কৃত হয় এবং তারপর আরও 70 বছর পর অর্থাৎ 1878 সালে ইলেকট্রন আবিষ্কৃত হয়। তৎকালীন বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের ভিত্তিতে ডালটনের পরমাণুবাদ রচনা, বিজ্ঞানের উন্নতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানীরা আজ আরও ছোটো কণা ইলেকট্রন, প্রোটন সৃষ্টি করেন। তাই ডালটনের পরমাণুবাদই পরমাণু গঠনের প্রথম সোপান বলা যেতে পারে।
পরমানু বিজ্ঞানীদের কাছে অদৃশ্য। এই অদৃশ্য বস্তুর ধারণাও বিজ্ঞানীদের কাছে খুব কঠিন। ফলে বিজ্ঞানীর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন মডেল সংযুক্ত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী আইনষ্টাইনের সেই বিখ্যাত উক্তি -
"তোমরা দূর থেকে মনে করো যে, আমি পরিতৃপ্তির সঙ্গে আমার বিগত জীবনের কাজের কথা চিন্তা করি। কিন্তু কাছ থেকে সবকিছু অন্যরকম দেখায়। এমন একটিও বৈজ্ঞানিক ধারণা নেই যার সম্বন্ধে আমার দৃঢ় প্রত্যয় আছে যে, সেটি চিরকাল অবিচল থাকবে।"
বর্তমানে পরমাণুর মধ্যে প্রায় 35 রকমের কণার সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এখানে কয়েকটির নাম উল্লেখ করা হল।
স্থায়ী কণা (Stable Particle): (i) ইলেকট্রন, (ii) প্রোটন (iii), নিউট্রন
অস্থায়ী কণা (Unstable Particle): (i) পজিট্রন (ii) মেসন (iii) নিউট্রিনো (iv) অ্যান্টি-নিউট্রিনো (v) অ্যান্টি-প্রোটন
সংমিশ্র কণা (Composite Particle): (i) ডয়টেরন (ii) আলফা কণা ইত্যাদি
জেনে রাখো: বর্তমানে প্রোটনকে মৌল কণা হিসাবে গৌণ করা হয়, কিন্তু এই প্রোটন কণা আবার কোয়ার্ক (Quark) নামে কয়েকটি সূক্ষ সূক্ষ কণা দ্বারা গঠিত।
COMMENTS